নভেম্বর ডায়াবেটিস সচেতনতা মাস। এ উপলক্ষে ২৪ নভেম্বর কংগ্রেসিয়া ও প্রথম আলোর আয়োজনে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন দেশের কয়েকজন স্বনামধন্য চিকিৎসক। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘ডায়াবেটিস আমার, দায়িত্বও আমার’। সহযোগিতায় ছিল হেলদি লিভিং ট্রাস্ট। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. তানজিনা হোসেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক এবং ডায়াবেটিস মেলার উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী। তাঁর বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরা হলো।
রোগীরা যখন জিজ্ঞেস করেন যে ডায়াবেটিস নিয়ে এত মাথাব্যথা করব কেন? আমি বলি, ভাই তোমার যে ডায়াবেটিস হলো, তোমার যে বন্ধুটির ডায়াবেটিস নেই তার থেকে তোমার আয়ু এক্ষুনি ৭ বছর কমে গেল। কী সাংঘাতিক কথা! কেন?
গ্লুকোজ তো আমার দরকার। প্রতিটি কোষ গ্লুকোজ ব্যবহার করে এনার্জি হিসেবে। আমার মস্তিষ্ক প্রায় পুরোপুরি গ্লুকোজের ওপর নির্ভরশীল। সমস্যা হলো এই এসেনশিয়াল ফুয়েলটা যদি আমি ঠিকমতো ব্যবহার করতে না পারি, সেটা আমার ক্ষতি করবে। এটার জন্যই ডায়াবেটিস হয়।
হয় আমার ইনসুলিনটা কমে গেছে (যেটা গ্লুকোজ ব্যবহার করাচ্ছে), অথবা আমার শরীরে প্রচুর ইনসুলিন আছে, কিন্তু নানা কারণে সেটা ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। তার ফল কী? প্রতিটি কোষ, প্রতিটি ভেসেলে (রক্তনালি) যে এনার্জি ইউটিলাইজেশনের মেকানিজম, সেখানে সমস্যা হচ্ছে।
তার ফলে কী হচ্ছে? ধরো, আমার ভেসেলে যে সেল লাইনিং আছে, সেটা তো প্রোটেকশন দিচ্ছে এবং আরও অনেক কাজ করে, কিছু কেমিক্যাল নিঃসরণ করে, যাতে ধমনি কলাপস না করে ওপেন থাকে, যেন রক্ত জমাট না বাঁধে।
এই সবকিছুর জন্য এনার্জি দরকার। যখন সেটা থাকে না, তখন কী হয়? মেটাবলিজম ঠিকভাবে না হলে শরীরে লিপিড বাড়ে। এ অতিরিক্ত লিপিড ভেসেলের মধ্যে জমতে থাকে, ধমনিগুলো চিকন হয়ে যায়।
এখন আমার ব্রেনে তো অসম্ভব পরিমাণ ব্লাড দরকার, অক্সিজেন দরকার। আমার হৃৎপিণ্ড মায়ের গর্ভ থেকে যেটা নড়াচড়া শুরু করেছে, যা মৃত্যু পর্যন্ত চলবে। তার অসম্ভব রকম এনার্জি দরকার। সেটা আসবে রক্ত দিয়ে।
কিন্তু যেসব ধমনি চিকন হয়ে গেল সেগুলো দিয়ে সঠিকভাবে খাবার অক্সিজেন না এলেই অর্গানগুলো ড্যামেজ হতে থাকে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ব্রেন, চোখ, হার্ট, কিডনি ও হাত-পায়ের ধমনিগুলো।
এরপর কী হয়? অনেক ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডেটা বলছে, ৭৫-৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর মৃত্যুর কারণ হলো কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ অথবা স্ট্রোক। কী মারাত্মক কথা! তাই আমি বলি, ডায়াবেটিস হওয়া মানেই তুমি হার্টের রোগী।
আজ অথবা আগামীকাল, সেটা যেকোনো সময় আসতে পারে। তোমার কাজ হলো সেটা যেন না আসে। তার জন্য জীবনযাপন পরিবর্তন করা, নিয়ম মেনে খাওয়া, সুগার নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। আর হার্টকে বাঁচাতে তিনটা ‘ডি’ দরকার—ডায়েট, ডিসিপ্লিন ও ড্রাগ।
ডিসিপ্লিন মানে কী? চলাফেরায় ডিসিপ্লিন, হাঁটাহাঁটিতে ডিসিপ্লিন, ঘুমে ডিসিপ্লিন। মনকে ভালো রাখা, আনন্দে থাকা এগুলোও জরুরি। প্রতিটি অর্গানকে শান্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়টি হলো ড্রাগ, ওষুধ।
ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছেন, সেটা খাব। রোগীরা খুব বিরক্ত হয় যে সারা জীবন ওষুধ খেতে হবে? এটা কী কথা? আমি বলি—ভাই, তুমি কি ভেবেছ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রোগ কোনটা? ক্ষুধা। জন্মের পরই বাচ্চা খাওয়ার জন্য কাঁদে, মৃত্যু পর্যন্ত খেতেই থাকে। খাওয়া না হলে কষ্ট হয় মানে ক্ষুধাও একটা রোগ!
কিছু রোগ আছে, যেমন নিউমোনিয়া বা টিবি নির্দিষ্ট সময় ওষুধ খেলেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু কিছু রোগ আছে যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়, পুরোপুরি ভালো করা যায় না। সেটা নিয়ে মাথাব্যথা না করে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।
ডায়াবেটিস হলে বুদ্ধিবৃত্তিক অবনতি ঘটে। হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা ২৫ শতাংশ বাড়ে। স্ট্রোকের আশঙ্কা চার গুণ বেড়ে যায়। সঙ্গে যদি কিডনির রোগ থাকে তাহলে আরও বাড়ে। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তো কথাই নেই।
ডায়াবেটিস প্রতিটি কোষে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে। এ জন্য একে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তাই ডায়াবেটিসে ভালো থাকতে চাওয়া আমার দায়িত্ব। আমি হার্ট অ্যাটাক চাই না। হার্ট ফেলিউর চাই না। স্ট্রোক চাই না। কিডনি ডিজিজ চাই না। চোখের অন্ধত্ব চাই না। ডায়াবেটিস থাকতে পারে কিন্তু আমি ভালো থাকব, সেটা আমার প্রতিজ্ঞা করতে হবে।

