৭ ডিসে ২০২৫, রবি

মধুপুরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাঁশ শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে

টাংঙ্গাইলে মধুপুর উপজেলার পাহাড়ী অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর শত বছরের বাঁশের তৈরি ঐতিহ্যবাহী শিল্প বিলুপ্তির পথে, যার প্রধান কারণ প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতা এবং বাঁশের দাম বৃদ্ধি।

এই শিল্পে জড়িত কারিগররা ন্যায্যমূল্য, পুঁজি ও সঠিক উদ্যোগের অভাবে পেশা পরিবর্তন করছেন, যা এই শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

মধুপুরের পাহাড়ী অঞ্চলের শাল গজারী বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মধুপুরের বন। এখানে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর গারো সম্প্রদায়সহ কোচ বর্মনের বসবাস মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে নারীরাই পরিবারের দায়িত্ব পালন করে আসছে।

নারীরা গৃহস্থালি সহ চাষাবাদের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের সাথেও জড়িত তারা। তাদের এই নিপুণ কর্মশৈলী দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছে।

মধুপুর উপজেলার ফুলবাগচালা ইউনিয়নের পীরগাছা গ্রাম। এখানকার অধিবাসী কেউ গারো সম্প্রদায়ের, কেউ কোচ-বর্মণ। তবে বেশিরভাগ বসতি কোচ বর্মন সম্প্রদায়ের। তাদের নিপুণ হাতে তৈরি হচ্ছে বাঁশের শৌখিন বাহারি পণ্য। এখানে তারা যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। তাদের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি অনেকটাই হারিয়ে গেছে। এখনও টিকে আছে বাঁশের কারুকাজ করা বিভিন্ন তৈজপত্র। কোচ নারীরা বাড়িতেই কুটির শিল্পের কাজ করে।

এছাড়াও নারীরা পুরুষের পাশাপাশি কৃষি কাজও করে থাকে। নারীরা কম বেশি সারা বছরই তারা বাঁশের কাজ করে থাকে। তাদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় হাত পাখা, কলমদানি, প্রিন্ট ট্রে, পেন হোল্ডার, সোবার, পানি রাখা জগ, ফুলদানি, টি-টেবিল ঝুড়িসহ নানা ধরনের জিনিস তৈরি করছেন তারা।

দোখলা পীরগাছা বর্মনপাড়ায় গিয়ে দেখা যার নারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের পাড়ায় কেউ কেউ গৃহস্থথালি, কেউ কেউ দিন মজুরি, কেউবা ক্ষুদ্র ব্যবসা, কেউ কেউ বাঁশের কাজও করে থাকে। এক সময় নিজের সংসারের কাজের পাশাপাশি সারা বছরই বাঁশের কাজ করত। বর্তমানে বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়া আর বাঁশ এখন তো পাওয়া যার না।

ওপর দিকে প্লাস্টিক পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের তৈরিকৃত পণ্যের চাহিদা কমে যাচ্ছে। তাদের গ্রামের প্রায় ২ হাজার ৩ শত ৫০ ঘরের নারীরাই কম বেশি বাঁশের কাজ করে থাকে বলে জানান রাধা রানী। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এসে তাদের বাঁশের তৈরি পণ্য কিনে নেয়। পুঁজির অভাবে তারা কুটির শিল্পের কাজ ঠিকমত করতে পারছেনা। এ জন্য বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। বাঁশের কাজ করেও তাদের অভাব থেকেই যাচ্ছে। তারা সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দাবি জানান।

উদ্যোক্তা লিটন নকরেক জানান, তার পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। অর্ডার আসলে তৈরি করে দেন। সে প্রতি মাসে ৫-৬ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করতে পারেন বলে জানান।

পীরগাছা গ্রামের বাঁশের কাজ করা রুপালী রানী বর্মন বলেন, ‘আমি ১৫ বছর যাবত এই বাঁশের কাজ করে আসছি এখনো করি আগের মত কাজ হয় না। বাঁশের দাম বেশি শ্রমিকের মজুরি বেশি। প্লাস্টিকের পণ্য আসার কারণে এখন আর বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র নিতে চায়না মানুষ। এই কাজ  এখন বিলুপ্তির পথে অনেকেই ছেড়ে দিয়েছে।’

সঞ্চিতা রানী বলেন, ‘দুই ছেলে মেয়ের সংসার। স্বামীর সংসারে সহযোগিতার জন্য সে বাঁশের কাজ করে থাকে। তার এক মেয়ে ক্লাস সেভেনে ও ছেলে কেজিতে পড়ে। পড়াশোনা শিখে তারা যেন মানুষের মতো মানুষ হয় এমনটাই তার চাওয়া। বাঁশের কাজে উপার্জিত অর্থ স্বামীকে দিয়ে সহযোগিতা করে।’

টোটন বর্মন বলেন, ‘এই কাজ করে আমি সংসার চালাই আগে এখন কাজ খুব কম, বিভিন্ন শৌখিন পণ্য তৈরি করি তালাই, পাখা, ধারি, গাছেক, ফুলদানিসহ।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *