রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেলেন সাবিনা ইয়াসমীন, উপহার দিলেন মনে রাখার মতো এক সন্ধ্যা

প্রায় ছয় দশকের পেশাদার সংগীতজীবন। তবে অসুস্থতার কারণে সম্প্রতি খুব বেশি গানে পাওয়া যায়নি তাঁকে। তবে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় পাওয়া গেল চিরচেনা সাবিনা ইয়াসমীনকে। সম্মাননা, গান আর স্মৃতিচারণায় হয়ে উঠল মনে রাখার মতো এক সন্ধ্যা। গতকাল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ছিল সাবিনা ইয়াসমীনকে সম্মাননা প্রদান এবং তাঁর একক সংগীতানুষ্ঠান। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে এ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।

শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় গান পরিবেশন করছেন সাবিনা ইয়াসমীন। ছবি: মীর হোসেন
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় গান পরিবেশন করছেন সাবিনা ইয়াসমীন। ছবি: মীর হোসেন

সাবিনা ইয়াসমীনের একক গানের অনুষ্ঠান ও সংবর্ধনার এ আয়োজন ঘিরে ব্যস্ততার শুরুটা গত সপ্তাহে। গত বুধবার শিল্পকলা একডেমির মহড়াকক্ষে ১৬ জনের যন্ত্রীদল নিয়ে মহড়ায় ব্যস্ত সময় পার করেন এই শিল্পী। সরেজমিন দেখা যায়, মহড়াকক্ষের বাইরে ভেসে আসছিল তবলা, হারমোনিয়াম, কি-বোর্ড, গিটার আর বেহালার সম্মিলিত সুর। যন্ত্রীরা বাজাচ্ছেন আর সবার মধ্যমণি হয়ে আছেন সাবিনা ইয়াসমীন। বাদ্যযন্ত্রের তালে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী, প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ। দেশ-বিদেশে কত অনুষ্ঠানে কতবার গেয়েছেন অথচ এখনো মহড়ায় কী নিষ্ঠা! কত একাগ্রতা! অপেক্ষার পর একটু বিরতি মিলল। হাসিমুখে জানালেন, যেকোনো অনুষ্ঠানের আগে এখনো নিয়মিত মহড়া করেন।

সন্ধ্যা ৭টা ২৭ মিনিটে আফজাল হোসেন মঞ্চে এসে অনুষ্ঠান শুরু করেন। শুরুতেই গতকাল প্রয়াত লেখক ও গবেষক, রাজনীতিক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। দেখানো হয় সাবিনা ইয়াসমীনকে নিয়ে নির্মিত সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৈরি ছোট্ট প্রামাণ্যচিত্র। সেখানে বরেণ্য এই শিল্পীকে নিয়ে কথা বলেন তাঁর সমসাময়িক, অগ্রজ ও অনুজ শিল্পীরা।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আফজাল হোসেন। মীর হোসেন
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আফজাল হোসেন। মীর হোসেন

প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী শেষে শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা সাবিনা ইয়াসমীনের ‘গীতিময় সেই দিন চিরদিন’ গানের তালে সমবেত নৃত্য পরিবেশন করেন।
এরপর মঞ্চে ওঠেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের যে ঐশ্বর্য আছে, সেই ঐশ্বর্যকে সেলিব্রেট (উদ্‌যাপন) করতে চাই। আজকে আমাদের এমন একজন সম্পদ সাবিনা ইয়াসমীন, তাঁকে আমরা সেলিব্রেট করছি। ওনার গান যে শুনব, শুধু তা–ই নয়, রাষ্ট্রের তরফ থেকে আজকে সম্মাননা জানানো হবে।’

অনুষ্ঠানে আসা অতিথিরা। মীর হোসেন
অনুষ্ঠানে আসা অতিথিরা। মীর হোসেন

শুরুতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে সাবিনা ইয়াসমীনকে সম্মাননা জানানোর কথা ছিল। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত হয়, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই তাঁকে সম্মান জানানো হবে। গত শনিবার তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে এ প্রস্তাব (রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সম্মাননা) দিলে তিনি বলেন, ‘আমি সম্মানিত বোধ করব।’

আরও পড়ুন

শিল্পকলায় আজ সাবিনা ইয়াসমীনকে সম্মাননা, একক সংগীতানুষ্ঠান

শিল্পকলায় আজ সাবিনা ইয়াসমীনকে সম্মাননা, একক সংগীতানুষ্ঠান

শুরু হয় সম্মাননা পর্ব। সাবিনা ইয়াসমীনকে উত্তরীয় পরিয়ে ও ক্রেস্ট দিয়ে সম্মাননা জানান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আজকে যাঁকে সম্মাননা দিচ্ছি, তিনি আমাদের কিংবদন্তি, সত্যিকারের গৌরব।’ তিনি অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে শিল্পীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশীদ, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান এবং শিল্পকলা একাডেমির সচিব মফিদুর রহমান। প্রতিক্রিয়ায় এই সম্মানের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

 সাবিনা ইয়াসমীনকে ‘মহানায়ক বুলবুল আহমেদ স্মৃতি সম্মাননা ২০২৫’ পদক দেন অভিনেতা বুলবুল আহমেদের স্ত্রী ডেইজি আহমেদ ও কন্যা ঐন্দ্রিলা আহমেদ
সাবিনা ইয়াসমীনকে ‘মহানায়ক বুলবুল আহমেদ স্মৃতি সম্মাননা ২০২৫’ পদক দেন অভিনেতা বুলবুল আহমেদের স্ত্রী ডেইজি আহমেদ ও কন্যা ঐন্দ্রিলা আহমেদভিডিও থেকে

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল গান ও স্মৃতিচারণা। এদিন একে একে শ্রোতৃপ্রিয় ১০টি গান গেয়ে শোনান সাবিনা ইয়াসমীন। গানগুলো হলো ‘সুন্দর সুবর্ণ’, ‘আমি রজনীগন্ধা’, ‘ফুল যদি ঝরে গিয়ে’, ‘শত জনমের স্বপ্ন’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘আমি আছি থাকব’, ‘ইশারায় শিস দিয়ে’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ ও ‘সে যে কেন এল না’। গানের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে আড্ডা।

শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় গান পরিবেশন করছেন সাবিনা ইয়াসমীন। ছবি: মীর হোসেন
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় গান পরিবেশন করছেন সাবিনা ইয়াসমীন। ছবি: মীর হোসেন

এদিন সাবিনা ইয়াসমীনকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন সাত সংগীতশিল্পী—খুরশীদ আলম, রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, নকীব খান, ফেরদৌস আরা, পার্থ বড়ুয়া ও আগুন। তাঁদের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে নানা জানা–অজানা গল্প। মাঝে সাবিনা ইয়াসমীনকে ‘মহানায়ক বুলবুল আহমেদ স্মৃতি সম্মাননা ২০২৫’ পদক দেন অভিনেতা বুলবুল আহমেদের স্ত্রী ডেইজি আহমেদ ও কন্যা ঐন্দ্রিলা আহমেদ। এ ছাড়া গায়িকাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন অভিনেত্রী নূতন। ঘড়ির কাঁটায় রাত যখন ৯টা ৪৫, তখন শেষ গান ‘সে যে কেন এল না’ পরিবেশন করেন সাবিনা ইয়াসমীন। তবে একা নন, মঞ্চে তাঁর সঙ্গী হন খুরশীদ আলম, রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, নকীব খান, ফেরদৌস আরা, পার্থ বড়ুয়া ও আগুন। রাত ১০টার দিকে যখন অনুষ্ঠান শেষ হয়, তখন মনে রাখার মতো এক সন্ধ্যার স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে ফিরতি পথ ধরছেন শ্রোতারা।

একজন সাবিনা ইয়াসমীন
১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সাবিনা ইয়াসমীন। ছয় বছর বয়সে গান গেয়ে প্রথম পুরস্কার জেতেন অল পাকিস্তান স্কুল মিউজিক কম্পিটিশনে। ১৯৬২ সালে রবীন ঘোষের সুরে ছোটদের জন্য গান গেয়ে সংগীতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করেন। একই বছর এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে গান করেন। ১৯৬৭ সালে আমজাদ হোসেন ও নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘আগুন নিয়ে খেলা’ চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক করেন। এরপর একে একে হয়ে ওঠেন বাংলা গানের অপরিহার্য কণ্ঠস্বর। সত্য সাহা, আলম খান, সুবল দাস, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলসহ অসংখ্য কিংবদন্তি সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রের গানসহ বিভিন্ন ধারায় ১৬ হাজারের বেশি গান রেকর্ড করেছেন এই শিল্পী। আধুনিক গান, পল্লিগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত ও গজল—সব ক্ষেত্রেই রেখেছেন সুরেলা স্বাক্ষর। বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র শিল্পী, যিনি ১৫ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে রেকর্ড গড়েছেন, পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৮৪), স্বাধীনতা পুরস্কারসহ (১৯৯৬) দেশে-বিদেশের বহু সম্মাননা। ২০২০ সালে প্রয়াত কবরী পরিচালিত ‘এই তুমি সেই তুমি’ চলচ্চিত্রে তিনি সর্বশেষ কণ্ঠ দেন। শুধু তা-ই নয়, ছবিটির চারটি গানে প্রথমবার সুরকার হিসেবেও কাজ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *