সমাজের অসহায় ও শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব। অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসার মাধ্যমেই রচিত হবে মানবিক সেতুবন্ধন। আমাদের সামান্য সহযোগিতা তাদের জীবনে এনে দিতে পারে একটুকরো সুখ। কনকনে শীতে ঠকঠক করে কাঁপা মানুষের গায়ে শীতবস্ত্র জড়িয়ে তার মুখে হাসি ফোটানোর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। এর মাধ্যমে প্রকাশ পায় মানুষের প্রতি আমাদের মমত্ব ও ভালোবাসার। আমরা চাইলেই এসব দুঃখী মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারি। এর জন্য কি অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া প্রয়োজন? মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরাও করতে পারেন অনেক কিছু। এসব অসহায়ের প্রতি তাদেরও রয়েছে কিছু নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের উপার্জিত অর্থের সামান্য পরিমাণও যদি এসব অসহায়ের জন্য আমরা বরাদ্দ করি তাহলে বিন্দু বিন্দু সে দান শীতার্তদের কষ্ট লাঘবে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে।
বড় অঙ্কের অর্থ দান করা জরুরি নয়। আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সঙ্গে অল্প দানও অনেক মূল্যবান। তা ছাড়া আমাদের অতিরিক্ত সোয়েটার, জ্যাকেট, কম্বল ইত্যাদি শীতবস্ত্র দান করার মাধ্যমেও আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি।
ইদানীং অসহায় ও শীতার্ত মানুষের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ‘মানবতার দেয়াল’ নামে একটি উদ্যোগ সবার নজর কেড়েছে। এসব দেয়ালে মানুষের প্রয়োজনীয় কাপড় ও শীতবস্ত্র থাকে। যাদের অতিরিক্ত কাপড় আছে তারা সে দেয়ালে তা রেখে যায়। সেখান থেকে যে কেউ তার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যেতে পারে। এটা ইতিবাচক একটি উদ্যোগ। সামজিক উদ্যোগে এ ব্যবস্থাটি আরও সুন্দর করা যেতে পারে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির অতিরিক্ত বাহনজন্তু বা বাহনের খালি জায়গা আছে, সে যেন বাহনহীন ব্যক্তিকে তা দিয়ে সাহায্য করে। কোনো ব্যক্তির যদি অতিরিক্ত পাথেয় থাকে তাহলে সে যেন পাথেয়হীন ব্যক্তিকে তা দিয়ে সাহায্য করে। বর্ণনাকারী বলেন, নবীজি (সা.) এভাবে আরও অনেক ধরনের সম্পদের কথা বললেন। তাতে আমাদের মনে হতে লাগল যে প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদে আমাদের কোনো অধিকার নেই।’- সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৭২৮। কিছু মানুষের একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগও ভালো লাগে। শীতবস্ত্র বিতরণের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় বিতরণ করলে তুলনামূলক সচ্ছল মানুষও শীতবস্ত্র নিয়ে যায়। এতে প্রকৃত অসহায় ব্যক্তিরা বঞ্চিত হয়। তাই তারা রাতে ১১টা-১২টার দিকে বিভিন্ন স্টেশনে অসহায় মানুষের থাকার জায়গায় ঘুরে ঘুরে শীতে কষ্ট করা মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। যেন প্রকৃত হকদাররাই এ দানে উপকৃত হন। তাদের আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিন। এ জাতীয় উদ্যোগ ব্যক্তিগতভাবেও গ্রহণ করা যেতে পারে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকেও এ ধরনের মহতি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সাধ্য ও সামর্থ্য অনুসারে আমরা তাদের সঙ্গেও শরিক হতে পারি।
অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও বিবেচ্য যে উপযুক্ত পাত্রের হাত পর্যন্ত তা পৌঁছাচ্ছে কি না। তাই স্বাভাবিকভাবে এদিক-ওদিক দেওয়ার চেয়ে খুঁজে খুঁজে যথাস্থানে অনুদান পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিও খেয়াল করার মতো। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘প্রকৃত অভাবী সে নয়, যে এক-দুই লোকমার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ফেরে; বরং প্রকৃত অভাবী তো সেই, যার সামর্থ্য নেই অথচ (সে মানুষের কাছে মুখ ফুটে চাইতে) লজ্জাবোধ করে। অথবা (তিনি বলেছেন) মানুষের কাছে গায়ে পড়ে চায় না।- সহিহ বুখারি, হাদিস ১৪৭৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১০৩৯
সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো শুধু সামাজিক দায়িত্বই নয় এটা মুসলিমের ধর্মীয় দায়িত্বও বটে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে- হে বনি আদম! আমি পিপাসার্ত ছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। বান্দা তখন বলবে, হে আল্লাহ্! আপনি উভয় জাহানের প্রতিপালক। আপনাকে কীভাবে পানি পান করাব? আল্লাহতায়ালা বলবেন, আমার অমুক বান্দা পিপাসার্ত হয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে পানি পান করাওনি। যদি তাকে পানি পান করাতে তাহলে সেখানে আমাকে পেতে (আজ তার প্রতিদান পেতে)। হে বনি আদম! আমি পীড়িত ছিলাম কিন্তু তুমি আমার সেবা করনি। তখন বান্দা বলবে, আপনি উভয় জাহানের প্রতিপালক কীভাবে আমি আপনার সেবা করব? তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। কিন্তু তুমি তার সেবা করনি। যদি তুমি তার সেবা করতে তাহলে আমাকে তার কাছে পেতে।… – সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ২৬৯। আল্লাহতায়ালা একটি কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে বনি ইসরায়েলের একজন ব্যভিচারিণী নারীকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন। তাহলে ভেবে দেখুন, যে ব্যক্তি একজন মানুষকে খাওয়াবে, পানি পান করাবে, বিপদাপদে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে, তার সঙ্গে আল্লাহতায়ালা কীরূপ আচরণ করবেন!
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর

