৭ ডিসে ২০২৫, রবি

সিজদায় আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার ৬ উপায়

নামাজ শুধু কিছু দোয়াতাসবিহের সমষ্টি নয় বরং নামাজ হলো এক প্রেমের আহ্বান, যেখানে দাস তার প্রভুর সামনে দাঁড়ায়, আনুগত্যে ন্যুয়ে পড়ে, আর নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে। আর তার মধ্যকার সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রেমমাখা মুহূর্ত হলোসিজদা। সিজদায় মানুষ পৃথিবীর বুকে মাথা রাখে, আর আসমানের মালিক তার দিকে দয়া নিয়ে ঝুঁকে পড়েন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন

أَقْرَبُ مَا يَكُوْنُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ

বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় যখন সে সিজদায় থাকে। সুতরাং ওই অবস্থায় তোমরা বেশি-বেশি করে দোয়া করো।’ (মেশকাত ৮৯৪, আবু দাউদ ৮৭৫)

কিন্তু আমাদের অনেকের সিজদা হয়ে যায় দ্রুত, অনুভূতিহীন, গভীরতা ছাড়া। হৃদয় ছুঁয়ে যায় না, আল্লাহর কাছে যাওয়ার মজা অনুভূত হয় না। তাহলে কীভাবে আমরা সিজদায় আল্লাহর নৈকট্য, প্রেম, মজা ও তৃপ্তি পাবো? কীভাবে সিজদা হবে আমাদের আত্মার প্রশান্তি, চোখের ঠাণ্ডা, হৃদয়ের অবকাশ? চলুন জেনে নিই, কীভাবে সিজদায় পাওয়া যাবে জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি-

১. আল্লাহর সামনে নিজের ক্ষুদ্র ভাবুন

সিজদায় যাওয়ার মুহূর্তে ভাবুন আপনি কার সামনে মাথা রাখছেন? কে সেই মহান সত্তা যাকে আসমানজমিনের সবকিছু সিজদা করে? আপনি সেই মহান রাজাধিরাজের সামনে মাথা রেখেছেন!

এই অনুভূতি হৃদয়ে এলেই সিজদা আর শুধু ইবাদত থাকে না, তা হয়ে যায় অশ্রুভেজা আত্মসমর্পণ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন

وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ

আসমানজমিনে যা কিছু আছে সবাই আল্লাহকে সিজদা করে।’ (সুরা রাদ: আয়াত ১৫)

২. আল্লাহর সান্নিধ্য অনুভব করুন

সিজদায় গেলে মনে করুন এখন আল্লাহ আপনার খুব কাছে… এখন তার সঙ্গে কোনো পর্দা নেই… এখন বলুন আপনার সব ব্যথা, সব লজ্জা, সব আশা, সব গোপন কথাগুলো…। যেভাবে বলতে বলেছেন নবীজী (সা.)

أَقْرَبُ مَا يَكُوْنُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ

বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় যখন সে সিজদায় থাকে। সুতরাং ওই অবস্থায় তোমরা বেশি-বেশি করে দু’আ করো।’ (মেশকাত ৮৯৪, আবু দাউদ ৮৭৫)

৩. ব্যথিত অন্তরের চাওয়াযা আল্লাহ সবচেয়ে ভালোবাসেন

একটি ভাঙা হৃদয়ের দোয়ায় যে আবেগ থাকে, তা আল্লাহ অত্যন্ত পছন্দ করেন। মনে মনে ভাবুন আল্লাহ আপনাকে কত দিচ্ছেন, অথচ আপনি কত অবাধ্য! তবুও তিনি আপনার রিজিক বন্ধ করেননি, বাতাস-পানি থামাননি, সূর্যের আলো কেড়ে নেননি। এই লজ্জা, প্রীতি ও অনুতাপ যখন সিজদায় উঠে আসে, তখন সিজদা হয়ে যায় জান্নাতের স্বাদমাখা। আল্লাহ তা’আলা বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দেন

وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ

তোমরা যেখানে থাকো, আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন। (সুরা হাদীদ: আয়াত ৪)

৪. সিজদায় গুনাহ ঝরে পড়ার অনুভূতি করুণ

সিজদা গুনাহ ধুয়ে দেয়। অতএব সিজদায় মনে করুন আর ভাবুন এখনই আপনার মাথা থেকে গুনাহের বোঝা ঝরে যাচ্ছে। আপনি হালকা হচ্ছেন। যেন সিজদা হয়ে যাচ্ছে এক আত্মিক গোসল। তাতে আপনার গুনাহভর্তি হৃদয় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন

مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْجُدُ لِلَّهِ سَجْدَةً إِلاَّ رَفَعَهُ اللَّهُ بِهَا دَرَجَةً وَحَطَّ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةً

যেকোনো বান্দাহ আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তার জন্য একটি সিজদা করে, আল্লাহ তা’আলা তার একটি মর্যাদা বাড়িয়ে দেন এবং তার একটি গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (তিরমিজি ৩৮৮, ইবনে মাজাহ ১৪২৩)

৫. ভাবুনসিজদা শয়তানের পরাজয়, মুমিনের বিজয়

সিজদায় যান এমন আনন্দ নিয়ে যেন আপনি জিতেছেন, আর শয়তান হেরে গেছে। মনে মনে ভাবতে থাকুন আপনার সিজদা শয়তানের অহংকার ভেঙে দিচ্ছে। আপনার সিজদা আল্লাহর প্রতি প্রেম ঘোষণা করছে। তাই আপনার সিজদা আপনার ইমানকে দৃঢ় করছে। এ আনন্দের সংবাদ রাসুলুল্লাহ (সা.) এভাবে ঘোষণা করেছেন-

إِذَا قَرَأَ ابْنُ آدَمَ السَّجْدَةَ فَسَجَدَ اعْتَزَلَ الشَّيْطَانُ يَبْكِي وَيَقُولُ: يَا ويله أُمِرَ ابن آدم بالسجود فَسَجَدَ فَلَهُ الْجَنَّةُ وأُمِرْتُ بِالسُّجُودِ فَأَبَيْتُ فَلِيَ النار

বনি আদম যখন সিজদার আয়াত পাঠ করে সিজদা করে, তখন শয়তান কাঁদতে কাঁদতে দূরে সরে যায় এবং সে বলতে থাকে, হায় দুর্ভোগ! আদম সন্তানকে সিজদা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ফলে সে সিজদা করল। সুতরাং তার জন্য রয়েছে জান্নাত। আর আমাকে সিজদা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু আমি অস্বীকৃতি জানিয়েছি। কাজেই আমার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন!’ (ইবনে হিব্বান ২৭৪৮)

৬. সিজদায় পূর্ণ আনুগত্য—‘আমার জীবন আল্লাহর জন্য’

এই অনুভূতি সিজদা পূর্ণ করে, প্রাণবন্ত করে, আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় করে তোলেএখনই নিজেকে সম্পূর্ণ তার জন্য সমর্পণ করুন আর ভাবুনহে আল্লাহ! আমার জীবন, মৃত্যু, দোয়াসবকিছু তোমারই জন্য।’ সিজদায় গিয়ে চোখের পানি ফেলে বলুন-

سُبْحَانَ رَبِّيَ الأَعْلَى

পবিত্রতা ঘোষণা করছি আমার সর্বোচ্চ মহান রবের জন্য।’ (তিরমিজি ২৬২, আবু দাউদ ৮৭০)

সিজদা কোনো সাধারণ আমল নয় এটা হলো বান্দা ও রবের মধ্যে সবচেয়ে গভীর যোগাযোগের মুহূর্ত। যেখানে চোখে পানি আসে, হৃদয় নরম হয়, গুনাহ ঝরে পড়ে, আর ঈমান ফুলের মতো ফুটে ওঠে।সিজদা হলো মুমিনের শান্তি, প্রেম ও সফলতার ঠিকানা। যে সিজদায় আনন্দ পায়, সে দুনিয়া-আখিরাত উভয় স্থানেই সফল।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের প্রত্যেকের প্রতিটি সিজদাকে হৃদয়ের আরাম, আত্মার প্রশান্তি, দুঃখের ওষুধ, গুনাহ মাফের মাধ্যম, আল্লাহর সান্নিধ্যের স্বাদ এবং জান্নাতের ঘ্রাণমাখা ইবাদত বানিয়ে দিন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *