সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলা, যেখানে যমুনা নদী কখনো শান্ত, আবার কখনো রুদ্ররূপে ধ্বংস ডেকে আনে। প্রতি বছর নদীর ভাঙনে হারিয়ে যায় আবাদি জমি, বসতভিটা আর গ্রামীণ জনপদ। আবার সেই নদীই বুক উজাড় করে দিয়ে নতুন চরের জন্ম দেয়। পানি নামার পর জেগে ওঠা চরগুলোতে দেখা মেলে পলিসমৃদ্ধ উর্বর জমির। সেখানে গজিয়ে ওঠে ছন গাছ, যাকে স্থানীয়রা বলেন ‘কাইশা’।
এবারের বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর হেমন্তের শুরুতে কাজিপুরের বিশাল চরাঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ছনের সবুজ শোভা। এখন কাশফুল ঝরে পড়ছে, আর চরজুড়ে দুলছে ছনক্ষেত। উপরে সাদা মেঘ, নিচে দোল খাওয়া সবুজ ছন। ধীরে ধীরে এই ছনক্ষেতগুলো সোনালি রঙে রূপ নিচ্ছে।
এই ছন এখন শুধু প্রকৃতির শোভা নয়, হয়ে উঠেছে কয়েক হাজার প্রান্তিক কৃষকের জীবিকার উৎস। বন্যার পানি নামার কিছুদিন পরই, যখন ছন এক থেকে দেড় ফুট উঁচু হয়, তখন থেকেই তা সংগ্রহ করা শুরু হয় পশুখাদ্য হিসেবে বিক্রির জন্য। চরের কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীরাও ছন সংগ্রহ করে গরুকে খাওয়ায়, আবার বিক্রিও করে বাজারে। এতে তাদের জীবিকার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিশ্চিত হয়।
যখন ছন আরো বড় হয় ও তাতে ফুল আসে, তখন পুরো চর রূপ নেয় এক খণ্ড সাদা আকাশে। সেই সময় থেকেই চরের মানুষ ছন কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ কাস্তে, কেউ ধারালো যন্ত্র হাতে ছোট নৌকায় চড়ে ছনক্ষেতে যায়। ছন কেটে আঁটি বাঁধা হয়, পরে তা মাথায় করে বা ঘোড়ার গাড়িতে করে নদীর ঘাটে নিয়ে আসা হয়। তারপর নৌকায় বাড়ি ফেরে। এক সপ্তাহ রোদে শুকানোর পর শুকনো ছন স্থানীয় হাটে বা পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয়।
পাইকাররা অনেক দূর থেকে এসে কৃষকদের কাছ থেকে স্তূপ করে রাখা ছন কিনে নিয়ে যান। সেই বিক্রির টাকায় অনেক চরের মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে।
ফুলজোড় চরের বারিক মিয়া বলেন,
‘কাইশা যখন একটু বড় হয়, তখন কেটে গরুকে খাওয়াই। বড় হলে রোদের মধ্যে শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করি। এখন তো এইটাই আমাদের ভরসা।’
সানবান্ধা চরের করিম শেখ, তেকানি গ্রামের আচফুল নেছা ও বদিউজ্জামান ব্যাপারীরাও জানান, এই ছনের টাকায় বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, ভূমিহীন অনেক মানুষ সংসার চালায়।
নতুন মাইজবাড়ি চরের সাবেক ইউপি সদস্য মোকলেছুর রহমান বলেন, ‘চরের অসহায় মানুষ বছরে চার-পাঁচ মাস ছন বিক্রি করেই জীবিকা চালায়। এখন এসব ছন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে যাচ্ছে। সেখানকার কারিগরেরা ছন দিয়ে ডালা, ঝাঁকা, ফুলদানির মতো অনেক ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করছেন, যা শুনেছি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।’

