মানুষের জীবনে মৃত্যু এক অবশ্যম্ভাবী সত্য। যার মুখোমুখি সবাইকে হতেই হবে। অথচ মানুষ সবচেয়ে বেশি এটিকেই এড়াতে চায়। মানুষ জীবনের নানা ব্যস্ততায় মৃত্যুকে দূরে ঠেলে রাখতে চায়। কিন্তু কোরআন ও হাদিস মানুষের সামনে যে বাস্তব সত্য তুলে ধরে, তা হলো; মৃত্যু মূলত কোনো সমাপ্তি নয়; বরং এক শাশ্বত যাত্রার সূচনা।
এই পরকাল-যাত্রার প্রতি মানুষের মনোভাবই নির্ধারণ করে সে কিভাবে মৃত্যুকে দেখবে। ভয়ের দরজা হিসেবে নাকি প্রিয় রবের সান্নিধ্যে পৌঁছানোর মহাসুযোগ হিসেবে। মহানবী (সা.) এক হাদিসে এই মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বুঝিয়েছেন যে, প্রকৃত মুমিনের জন্য মৃত্যু মুহূর্তটি আসলে এক পবিত্র অভ্যর্থনা, এক প্রশান্তির আহ্বান। আর কাফিরের জন্য সেটি হয়ে দাঁড়ায় অপরাধের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ভীতিকর মুহূর্ত।
নিচের হাদিসটি এই সত্যকে অত্যন্ত গভীর, হৃদয়-স্পর্শী ভঙ্গিতে স্পষ্ট করেছে-
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ أَحَبَّ لِقَاءَ اللهِ أَحَبَّ اللهُ لِقَاءَهُ وَمَنْ كَرِهَ لِقَاءَ اللهِ كَرِهَ اللهُ لِقَاءَهُ قَالَتْ عَائِشَةُ أَوْ بَعْضُ أَزْوَاجِهِ إِنَّا لَنَكْرَهُ الْمَوْتَ قَالَ لَيْسَ ذَاكِ وَلَكِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا حَضَرَهُ الْمَوْتُ بُشِّرَ بِرِضْوَانِ اللهِ وَكَرَامَتِهِ فَلَيْسَ شَيْءٌ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا أَمَامَهُ فَأَحَبَّ لِقَاءَ اللهِ وَأَحَبَّ اللهُ لِقَاءَهُ وَإِنَّ الْكَافِرَ إِذَا حُضِرَ بُشِّرَ بِعَذَابِ اللهِ وَعُقُوبَتِهِ فَلَيْسَ شَيْءٌ أَكْرَهَ إِلَيْهِ مِمَّا أَمَامَهُ كَرِهَ لِقَاءَ اللهِ وَكَرِهَ اللهُ لِقَاءَهُ
উবাদাহ ইবনু সামিত (রা.) হতে বর্ণিত। মহানবী (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ পছন্দ করে, আল্লাহ্ও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে না, আল্লাহ্ও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন না। তখন ’আয়িশাহ (রা.) অথবা তাঁর অন্য কোকো স্ত্রী বললেন, আমরাও তো মৃত্যুকে পছন্দ করি না। তখন মহানবী (সা.) বললেন: ব্যাপারটা এমন নয়। আসলে, যখন মুমিনের মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার সম্মানিত হবার খোশ খবর শোনানো হয়। তখন তার সামনের খোশ খবর চেয়ে তার নিকট অধিক পছন্দনীয় কিছু হতে পারে না। কাজেই সে তখন আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করাকেই ভালোবাসে, আর আল্লাহ্ও তার সাক্ষাৎ ভালবাসেন। আর যখন কাফিরের মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন তাকে আল্লাহর ’আজাব ও গজবের সুসংবাদ দেয়া হয়। তখন তার সামনে যা থাকে তার চেয়ে তার কাছে অধিক অপছন্দনীয় আর কিছুই থাকে না। সুতরাং সে তখন আল্লাহর সাক্ষাৎ অপছন্দ করে, আর আল্লাহ্ও তার সাক্ষাৎ অপছন্দ করেন। (বুখারি, হাদিস : ৬৫০৭)
হাদিসের মূল শিক্ষা
১. মৃত্যুভয় স্বাভাবিক—কিন্তু মুমিনের জন্য মৃত্যু হচ্ছে মহা-সাক্ষাতের দরজা
’আয়িশাহ (রা.)-এর প্রশ্নই প্রমাণ করে যে মৃত্যুভয় মানবিক প্রবৃত্তি। ইসলাম এটিকে অস্বীকার করে না। কিন্তু হাদিসটি শেখায়- মৃত্যুকে অপছন্দ করা মানেই আল্লাহর সাক্ষাৎ অপছন্দ করা নয়।
বরং আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করা মানে হচ্ছে; হৃদয়ে পরকালের প্রত্যাশা ও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতার আকাঙ্ক্ষা জাগরুক থাকা।
২. মৃত্যুমুহূর্তে মুমিনকে দেয়া হয় বিশেষ ‘বুশরা’ বা আলোর সুসংবাদ
হাদিসে বলা হয়েছে, মৃত্যুর মুহূর্তে মুমিনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি, রহমত ও সম্মানের সুসংবাদ দেয়া হয়। এটি সত্যিকারের আত্মশান্তির চূড়ান্ত মুহূর্ত; যেখানে ফেরেশতারা মুমিন বান্দাকে অভিনন্দন জানান। এই সুসংবাদ যখন সামনে আসে, তখন মুমিনের মনে আর কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না। সে উৎসুক হয়ে ওঠে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
৩. কাফিরের জন্য মুত্যু মানে শাস্তির মুখোমুখি হওয়া
কাফিরের মৃত্যুমুহূর্তে ফেরেশতারা জানান দেয় ‘গজব’ ও ‘শাস্তি’-র সংবাদ। ফলে তার কাছে মৃত্যু ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এই ভয়ই তার অন্তরে আল্লাহর সাক্ষাৎ-অপছন্দ জন্মায়। অর্থাৎ, আল্লাহ তাকে অপছন্দ করেন; কারণ সে সত্যকে অস্বীকার করে এসেছে।
মুমিন যখন আল্লাহর সাক্ষাৎকে স্বাগত জানায়, তখন আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন।
আর কাফির যখন আল্লাহর সাক্ষাৎকে অপছন্দ করে, তখন আল্লাহও তাকে অপছন্দ করেন।
মূল কারণ—; মৃত্যুর মুহূর্তে তাদের সামনে ভিন্ন ভিন্ন পরিণতির সুস্পষ্ট ঝলক ফুটে ওঠে।

